post

ফিরে দেখা ২০২৩ সাল

নূরুল ইসলাম

০৩ জানুয়ারি ২০২৪

“আগামী ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে ঘিরে সারা দেশের জনগনের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেশের সকল দলই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে মাঠে সরব। জনগনের কাছে ভোট চাচ্ছে। নেতারা বড় বড় সমাবেশে জনগনকে দেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। নির্বাচনী পরিবেশ ঠিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক তৎপর রয়েছে। মিডিয়াগুলো স্বাধীনভাবে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করছে। দেশের অর্থনীতি, মানবাধিকার আর জনগণের মৌলিক অধিকার আজ সুদৃঢ়।”

এমন ধরনের বাক্য বিন্যাস দিয়ে যদি এদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরা যেতো তবে তা কতইনা ভালো হতো! 

উপরোক্ত প্রত্যাশাটা তরুণ প্রজন্ম হিসেবে আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হলেও স্বাধীনতার বিন্দুমাত্র কোনো স্বাদ এ জাতি পায়নি। পাকিস্তানের হাত থেকে এদেশ মুক্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু আধিপত্যবাদীদের নীল থাবায় দেশের মানুষ আজ অর্ধমৃত। পরিবারতন্ত্রের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আমরা আমাদের স্বাতন্ত্র্যবোধ হারিয়ে ফেলেছি। গোলামির জিঞ্জিরই আমাদের নিয়তি ধরে- না মরে বেঁচে আছি। দেশটি আজ উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছে। বর্তমান ভোট চোর মাফিয়া সরকার এদেশের জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। উন্নয়নের সস্তাবুলি তুলে জনগণকে বোকা বানাতে চায়। একদিকে বিরোধী নেতাকর্মীদের জেলে আটকে রেখে একের পর এক সাজা দিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নিজেদের ডামি প্রার্থী দিয়ে আরেকটি পাতানো নির্বাচনী খেলায় মেতেছে নিশিরাতের এ ফ্যাসিবাদী সরকার। তবে এর পরিণতি যে মারাত্মক হবে তা স্বয়ং শেখ হাসিনাও জানে। কিন্তু তারও কিছু করার নাই। কারণ সে দেশের বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ, আইন বিভাগসহ সর্বক্ষেত্রেই আজ দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। এমপি মন্ত্রীরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে। গত ১২ এবং ১৩ই ডিসেম্বর’২৩-এ প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদে দেখানো হয়েছে গত ১০ বছরে শিক্ষা মন্ত্রীর আয় বেড়ে হয়েছে ৪১ গুণ আর সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৫৯গুণ। রেলমন্ত্রীর স্থাবর সম্পত্তি বেড়েছে ৩২গুণ। ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর সম্পদ বেড়ে ৮৬গুণ এবং বিমান প্রতিমন্ত্রীর ব্যাংকে জমা বেড়ে ৪৮গুণ। এ সকল তথ্য তারা হলফনামায় জমা দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র এর চাইতেও অনেক ভয়ানক। তারা দেশের দায়িত্ব পেয়ে যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়েছে। সুতরাং ক্ষমতার পালাবদলের পর তার এবং তার দলের অবস্থা কী হবে সেটা আর নাই বললাম। 

যাই হোক, দুঃস্বপ্নের মতো একটি আতঙ্কময় বছর পার হয়ে গেল আমাদের মাঝ থেকে। অসহিষ্ণুতা আর নিরাপত্তাহীনতার ঘোরতর অন্ধকারে নিমজ্জিত আজ গোটা স্বদেশভূমি। সবার মাঝেই বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। বীরের জাতি আজ কথা বলার অধিকারটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। আবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে নিজভূমে ফ্যাসিবাদ আর স্বৈরাচার তাড়ানোর। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তার নীল নকশা বাস্তবায়ন শুরু করে। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় কোনো ভোট ছাড়াই ১৫৩টি আসনে আওয়ামীলীগের সংসদ সদস্য হয়। তথাকথিত গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার এটিই গনতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা। এরপর ২০১৮ সালে ড. কামালের ঘাড়ে ভর করে বিরোধীদের নিয়ে এসে সংঘাতময় (১৫জন নির্বাচনি সহিংসতায় নিহত হয়) একটি নির্বাচনের আয়োজন করা হয় যেখানে বিরোধী দলের অসংখ্য প্রার্থীকে জেলে আটকে রেখে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। প্রায় সব আসনেই পুলিশ, র‌্যাব এমনকি সেনাবাহিনী কর্তৃক বিরোধীদের ব্যাপক নির্যাতন এবং হামলা করা ও মামলার আসামী করা হয়। ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান করা হয়। আওয়ামী সমর্থক কর্তৃক আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা ইত্যাদি সকল অপকর্ম তারা করে। এ যেন ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি। এ বছর আবার নতুন নকশা করে নিজেদের ডামি প্রার্থী দিয়ে তামাশার আয়োজন হতে যাচ্ছে ৭ই জানুয়ারি। 

আওয়ামী লীগ এ দেশের জন্য একটি অভিশাপের নাম। যখনই তারা ক্ষমতায় এসেছে তখনই তারা দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা এমনকি স্বার্বভৌমত্বও বিকিয়ে দিয়েছে। এ নিবন্ধে আমরা ২০২৩ সালে দেশের সামগ্রিক চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করব। 

টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বছরের শুরুতে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু নভেম্বর ২০২৩-এ এই রিজার্ভের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ১৯ বিলিয়ন ডলারে। উল্লেখ্য জানুয়ারি ২০২২-এ দেশে সামগ্রিক রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। 

The Business Standard (২৩ই ডিসেম্বর ২০২৩) পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে, সরকার তার আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে; অথচ এই ঋণের লিমিট ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে সরকার ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। 

ডলারের মূল্য স্বাধীন বাংলাদেশে যে-কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক ১১৫ টাকা ডলারের মূল্য নির্ধারণ করলেও ডিসেম্বর নাগাদ খোলাবাজারে রেকর্ড ১২৯ টাকায় ডলার বিক্রি হয়েছে। দেশে মূদ্রাস্ফীতির পরিমাণ গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বছরের শেষে খাদ্য মূদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিল ১২ শতাংশের ওপরে। আর সামগ্রিক মূদ্রাস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। যার ফলে দ্রব্যমূল্যের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে আকাশচুম্বী। মধ্যবিত্ত এবং স্বল্প আয়ের মানুষদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তবে এদিকে শাসক গোষ্ঠীর ভ্রুক্ষেপ আছে বলে প্রতিভাত হয়নি। 

দেশের রপ্তানি আয়ের ‘অক্সিজেন’ খ্যাত পোষাক খাত। বাংলাদেশ যেখান থেকে বার্ষিক ৮০ ভাগের বেশি রপ্তানি আয় করে থাকে। পুরো বছর জুড়েই অস্থির অবস্থার মধ্যে ছিল এ খাতটি। ধারাবাহিতভাবে যেমন পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি কমেছে, তেমনি নতুন করে রফতানি আদেশও কমেছে ২৫-৩০ শতাংশ (সূত্র : দৈনিক সময়ের আলো, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩)। 

এদিকে খেলাফি ঋণে রেকর্ড গড়েছে বর্তমান লুটেরাজ সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ শতাংশের বেশি। বিশেষ করে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকসমূহের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২১ শতাংশ। অথচ আইএমএফের পরামর্শ ছিল ১০ শতাংশের নিচে নিয়ে আসা। আর সবচেয়ে আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, বেসরকারি ব্যাংকসমূহের অধিকাংশই আওয়ামীলীগের কর্তা ব্যক্তিদের মালিকানাধীন। শুধুমাত্র এস আলম গ্রুপের অধীনেই ৭টি ব্যাংকের মালিকানা রয়েছে। আর দেশের ঋণ খেলাপিদের অধিকাংশই সরকারী নেতাকর্মী। ফলে ব্যাংকগুলো তা আদায় করতেও ব্যর্থ হচ্ছে। দেশের জনগণের সঞ্চিত টাকা লুটপাটের এক বৈধ পন্থা বেছে নিয়েছে আওয়ামী দোসররা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ নাগাদ দেশে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছাড়িয়েছে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ সরকারের আমলে ঋণের বোঝায় নূয্যমান হয়ে পড়েছে দেশটি। চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের বুলি আওড়ানো আওয়ামীলীগ সরকার উন্নয়নের যেসকল মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে তার অধিকাংশই বৈদেশিক ঋণের অর্থে। এই ঋণ ২০২৪ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে পরিশোধ করতে হবে। অথচ দেশের রিজার্ভের অবস্থা খুবই খারাপ। জনশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে না পারলে আর নিরাপদ বিনিয়োগের পরিবেশ না তৈরি করতে পারলে টেকশই উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। বরং তা হিতে বিপরীত হবার আশংকাই বেশি। 

রাজনৈতিক সহিংসতা ও মানবাধিকারের চরম অবনতি

আওয়ামী সরকারের অধীনে আইনের শাসন, গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা এবং নারীর অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলিতে মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। চলতি বছরের পুরো সময় জুড়েই দেশে নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে নির্দিধায়। মিথ্যা মামলা, গণগ্রেফতার, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেআইনি আচরণের ঘটনাগুলো স্বাধীন দেশের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, সাংবাদিকরা হামলা ও গ্রেফতারের সম্মুখীন হয়েছে যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক।

বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নৈরাজ্য এবং সংঘাত চলমান রয়েছে। ২৮শে অক্টোবর বিরোধী দলগুলোর সমাবেশ ও পরবর্তী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যার ফলে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, সাংবাদিক, পরিবহণ শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মীসহ অনেক মানুষ নিহত হয়েছে। এর সাথে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সারাবছর জুড়েই অসংখ্য মামলা এবং গ্রেফতার অব্যহত ছিল। যা বিরোধীদের কণ্ঠকে দমন করার প্রধান হাতিয়ার ছিল। বিশেষ করে বছরের শেষ দিকে এসে গুপ্ত হামলা, গণগ্রেফতার, নির্বাচন-তফসিল পরবর্তী সহিংসতা, বিরোধী নেতাদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতার এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি ও পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায় প্রশাসন ও আওয়ামী দোসরদের বিকৃত মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ।  

মানবাধিকার সংগঠনসমূহের সূত্র মতে, গত বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার ৮০৭টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৮২ জন ও আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৮১৫০ জন। যার অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের অন্তঃকোন্দল এবং বিএনপির পদযাত্রা ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগের পাল্টা শান্তি সমাবেশকেন্দ্রিক সংঘর্ষের ঘটনা। তাছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দ্বারা ৮২৬৩ জন রাজনৈতিক গ্রেফতারের শিকার হয়, তন্মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের ৮০২৪ জন। একই সময়ে, বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৪৩৩টি মামলায় ১৩৮০৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরো ৫৮১৮৯ জনকে অজ্ঞাত আসামী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। বিরোধী দলসমূহের সভা সমাবেশের আয়োজনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ৩২৫৯ জন আহত এবং সমাবেশ কেন্দ্রিক ৫৭৮৪ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়াও গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত নির্বাচনি সহিংসতার ৬৯টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ০৪ জন এবং আহত হয়েছে কমপক্ষে ৫৩৭ জন বিরোধী দলের নেতা কর্মী ও সাধারণ জনতা।  

১৮ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী গত ১৪ সপ্তাহে ৭৯টি মামলায় ১হাজার ২৪৯ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির দলীয় সূত্র অনুযায়ী ২৮শে অক্টোবরের পর থেকে ১৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপির ২১ হাজার ৮৩৫ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী বিরোধী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ওপরও চলছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার খড়গ। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের তথ্য মতে গত বছরের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট গ্রেফতার হয়েছে ৩২০২ জন এবং নিহত হয়েছে ৩ জন জামায়াত কর্মী। 

গত বছর যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুম এবং নির্বিচারে বিরোধীদের ওপর গুলি বর্ষনের ঘটনা কম ঘটেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক মে মাসে ঘোষিত নতুন ভিসা নীতি। এরই জের ধরে দীর্ঘ ১০ বছর পর ১০ জুন ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউটে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে প্রকাশ্য সমাবেশের অনুমতি প্রদান করতে সরকার বাধ্য হয়। পরবর্তীতে ২৮ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে অনুমতি ছাড়াই জামায়াতে ইসলামী ঢাকার আরামবাগে ঘোষণা দিয়ে বিনা বাধায় মহাসমাবেশ করে। একই দিনে বিএনপির সমাবেশে পুলিশি হামলায় তাদের সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। 

২০২৩ সালের প্রথম ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ¦ারা/হেফাজতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ৩১টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ৩৩ জন। যাদের মধ্যে ০৭ জন তথাকথিত ক্রসফায়ার/বন্দুকযুদ্ধের নামে, ০৭ জন নির্যাতনে এবং ১৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় ৫ জন মারা গিয়েছে। এছাড়াও কারা হেফাজতে ৭০ জন মারা গেছেন। 

উল্লেখ্য, বিগত এগারো মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে কমপক্ষে ২৮ জনকে, যাদেরকে অন্তত ৭২ ঘণ্টার মাঝে আদলতে সোপর্দ কিংবা তাদের পরিবারকে তুলে নেওয়ার বিষয়ে অবহিত করা হয়নি। ১৯ জনকে পরবর্তীতে গ্রেফতার দেখানো এবং ৩ জনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও বাকি ৬ জনের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ২৪ ঘন্টায় নিন্ম আদলতে সোপর্দ এবং ১২ ঘণ্টার মাঝে পরিবারকে জানানোর বিষয়ে আদলতের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকলেও অন্তত ১০ জনকে অবৈধভাবে আটকে রাখা হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গিয়েছে যাদের মধ্যে ৬ জনকে মুক্তি দেওয়া হলেও বাকি ৪ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

উপরের চিত্রসমূহ থেকে এটি প্রতিভাত হয় যে, এ দেশে ন্যূনতম আইনের শাসন বর্তমান নেই। জনগণের কথা বলার অধিকার হরণ করা হয়েছে। পশ্চিমাদের প্রেসারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে ১৩ই সেপ্টেম্বও ২০২৩ তারিখে সরকার সাইবার নিরাপত্তা বিল-২৩ সংসদে পাশ করে। এই আইনটি মূলত মিডিয়াকে কোনঠাসা করে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করা, জনসাধারণকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করা এবং বিরোধী মত দমন করার অস্ত্র। জামায়াতে ইসলামীর আমীর এবং সেক্রেটারিকে একের পর এক মামলা দিয়ে কারাগারে অন্তরীন রাখা হয়েছে। হাই কোর্টের নো অ্যারেস্ট নো হ্যারেজ অর্ডার থাকলেও অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরোয়ার এবং শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানকে জেল গেট থেকে এ বছর একাধিকবার রি-অ্যারেস্ট করা হয়। যা দেশের পরাধীন বিচার ব্যবস্থার নিকৃষ্ঠ এক দৃষ্টান্ত। এছাড়া বিএনপির মহাসচিবসহ সিনিয়র প্রায় সকল নেতাই এখন পর্যন্ত কারাগারে রয়েছে। মূলত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের গণতন্ত্রকেই কারাগারে নিক্ষেপ করে রেখেছে। 

মাদকের অভয়ারণ্য, অসুস্থ সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা ও কিশোর গ্যাং

বাংলাদেশ এখন মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রকাশ্যে মাদক গ্রহণ করলে জরিমানার ব্যবস্থা রেখে আইন পাশ করা হয়। কিন্তু সে আইনের কোনো বাস্তবায়ন আওয়ামী আমলে না হওয়ায় বিগত ১৫ বছর দেশে মাদকের ব্যাবসাসহ মাদক সেবীদের পরিমাণ ভয়ংকর হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে তরুণদের পাশাপাশি দেশের শিক্ষিত তরুণীদের মধ্যেও মাদক গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে নারী ক্ষমতায়নের নামে অশ্লীল, বিকৃত এবং রুচিহীন সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৭০ লক্ষ মাদকসেবী রয়েছে। যার ৮০ ভাগই তরুণ-তরুণী। সরকারি এ হিসেবের বাহিরে প্রকৃত অবস্থা আরো ভয়াবহ। মাদকের পেছনে বছরে খরচ হয় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। যা দিয়ে ২টি পদ্মাসেতু তৈরি করা সম্ভব। গত বছর প্রথম ৫ মাসে ৪২ হাজার মাদকের মামলা হয়েছে যাতে আসামী করা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৩৪ জনকে এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ১১ হাজার ২৩১ জনকে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আংকটাডের প্রকাশিত গত বছরের ৮ জুনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মাদকের কারণে বাংলাদেশ থেকে ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে (সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৩ জুন ২০২৩)। সন্তানদের নিয়ে পিতামাতারা আজ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। গত বছরের প্রায় প্রতি সপ্তাহেই পত্রিকায় নিউজ হয়েছে যে, মাদকসহ ছাত্রলীগ নেতা/ যুবলীগ নেতা/ আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার হয়েছে। ক্যাম্পাসের অধিকাংশ ছাত্রলীগ নেতাই মাদক এবং নারীতে আশক্ত। ফলে তাদের অনুসারীদের কারণে সাধারণ ছাত্র এবং যুবকেরা মাদকের করাল গ্রাসে নিপতিত হয়েছে। যুব সমাজকে মাদকে ডুবিয়ে রাখতে পারলেই তারা তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারবে সহজেই। কারণ তারুণ্যের শক্তিই একটি সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। গড়তে পারে নতুন দিগন্ত। 

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১ম এগারো মাসে ২২৫৯ জন নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৪২ জন, যাদের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ৫৩৫ জন (৫৬%) ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে ১৭৭ জন (১৯%) নারী ও শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪০ জনকে যাদের মধ্যে শিশু ২৬ জন এবং ৭ জন ধর্ষণের শিকার নারী আত্মহত্যা করেছে। ৬৮৩ জন নারী ও শিশু যৌন নিপীড়ণের শিকার হয়েছেন তন্মধ্যে শিশু ৩৭৬ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬৮ জন নারী এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫৮ জন ও আত্মহত্যা করেছেন ৬ জন। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ২৯১ জন, আহত হয়েছে ৯৬ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১১১ জন নারী। অন্যদিকে ২০৭৮ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে যাদের মধ্যে ৪৮১ জন প্রাণ হারিয়েছে। ওপরের এই চিত্রটা নিশ্চয়ই কোনো স্বাধীন দেশের কোনো চিত্র নয়। এই ভয়াবহ অবস্থার অন্যতম কারণ হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে চারু কলা ও সংস্কৃতির নামে নাস্তিকেরা ধর্মশিক্ষাকে অত্যন্ত সংকীর্ণ করেছে। মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশটির জন্য তা সুদূর প্রসারী ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসবে।

বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে বিকৃত এবং পাশুবিক যৌনাচারকে ছড়িয়ে দিতে তারা মানবতা বিধ্বংসী ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুকে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরেছে। আওয়ামী লীগ যে কত  ড়ো বিকৃত চরিত্রের মানুষদের সংগঠন তা সহজেই অনুমেয় হচ্ছে। এই দলটি মুরতাদদের দালাল হিসেবে এদেশে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাং গড়ে তুলে আভ্যন্তরীন অশান্তি গড়ে তুলছে এই ফ্যাসিস্ট বাহিনী। 

শ্রমিক অসন্তোষ 

ন্যায্য মজুরির দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন মানবাধিকার সংকটের ক্ষেত্রে আরেকটি মাত্রা যুক্ত করেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, শ্রমিকদের আন্দোলনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারদলীয় কর্মীদের দ্বারা দমনের সম্মুখীন হয়। ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১২৬ জন শ্রমিক নিহত এবং ২০৮ জন শ্রমিক আহত হয়। এ সময়ে ১৮৩ টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে ৩ জন সহ নিহত হয়েছেন ৩৬ জন এবং আহত হয়েছেন ৩৪৫ জন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং শ্রমিকদের সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাবে দুর্ঘটনায় ১৩৭ জন শ্রমিক তাদের কর্মক্ষেত্রে মারা গেছেন। দেশে যখন চরম মুদ্রাস্ফীতি চলছে তেমন একটি পরিস্থিতিতেও মাত্র ১২৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারন করে আইন পাশ করে গণবিচ্ছিন্ন এই সরকার। শ্রমিকদের দাবির কোনো তোয়াক্কাই তারা করেনি।

সাংবাদিক নির্যাতন 

সমাজের দর্পন হিসেবে কাজ করে সাংবাদিকগণ। মিডিয়াকে বলা হয় রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ। কিন্তু সাংবাদিক এবং মিডিয়াকে হলুদ সাংবাদিকতার মোড়কে আটকে রাখা হয়েছে। বছর জুড়েই হামলা মামলার স্বীকার হয়েছে সাংবাদিকরা। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য মতে, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এগারো মাসে ১৬৮টি হামলার ঘটনায় ২৭৫ জন সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছে। গত এগারো মাসে ২জন সাংবাদিক নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে অন্তত ১৭৪ জন, লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ৮২ জন, হুমকির শিকার হয়েছেন ১৭ জন ও গ্রেফতার হয়েছেন ০৯ জন।

সর্বোপরি, ২০২৩ সালের পুরো বছরের দিকে লক্ষ্য করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, একটি আতঙ্কিত বছর আমরা পার করেছি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিরোধী মতের ওপর জুলুম নিপীড়নের চরম মাত্রা, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দ্রব্যমূল্যেও উর্ধ্বগতি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণগ্রেফতার, হত্যা, ধর্ষণ, গুম, খুনসহ এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হয়েছে এই একটি বছর। বছরের শেষ দিকে এসে তা আরও ভয়ানক আকার ধারণ করে। সর্বশেষ গত আটাশে অক্টোবর বিএনপি-জামায়াতের মহাসমাবেশের পর থেকে গণগ্রেফতারের নামে এই ফ্যাসিবাদী সরকার আতঙ্কের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। তড়িগড়ি করে পুরনো সব মামলার রায় দিয়ে বিরোধী দলগুলোকে দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা করে। কিন্তু এদেশের জনগণ কখনো স্বৈারাচারকে মেনে নেয়নি। তারই চিত্র ফুটে উঠেছে এই বিজয়ের মাসে বিরোধী দলগুলোর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের আন্তরিক সমর্থনের মাধ্যমে। আগামী সংসদ নির্বাচন যেন একতরফা না হয় সেজন্য বিরোধী দলগুলো বছরের শেষপ্রান্তে এসে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। আশা করা যায় এই আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন ঘণ্টা বেজে উঠবে। আর ২০২৪ সাল হয়ে উঠবে এক প্রশান্তিময় বছর।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, ছাত্রসংবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির