post

বাংলাদেশের ভূ

নূরুল ইসলাম

০৮ অক্টোবর ২০২৩

বর্তমান বাংলাদেশ এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার ধীরে ধীরে দেশকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যে সংকটের শুরু হয়েছে কিন্তু শেষ কীভাবে হবে তা বলাটা কঠিন। বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে দেশের সার্বিক মূদ্রাস্ফীতি বর্তমানে ৯.৯২ শতাংশ (সূত্র : বিবিএস)। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিতে মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। দেশে রিজার্ভের পরিমাণ কমে ২০ বিলিয়ন ডলারে নামার কারণে আমদানির ওপর রয়েছে সরকারি নিয়ন্ত্রণ, ফলে দ্রব্যমূল্যের দামের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। অথচ পাশর্^বর্তী শ্রীলঙ্কায় ৬৯ শতাংশ মূদ্রাস্ফীতি কমে এখন ৫ শতাংশের ঘরে। প্রশ্নটা হলো শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তান যদি পারে, তবে আমাদের দেশের এত ভালো অর্থনীতি হবার পরেও পারছি না কেন? মূল কথা হচ্ছে সরকারি সদিচ্ছার অভাব। এদেশে অর্থনীতির এমন অবস্থা থাকা সত্ত্বেও দেশের প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত রয়েছে ভারত, চীন, রাশিয়া কিংবা আমেরিকার নেক দৃষ্টির পেছনে। জনগণ এখন তাদের কাছে জিম্মি বা অনেকাংশে দাসে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে দেশে বিভাজনের রাজনীতি যোগ দিয়েছে নতুন মাত্রা। লক্ষ লক্ষ গায়েবি মামলা দিয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলকে চরম কোণঠাসা করে রেখেছে, অপর দিকে মানুষের মৌলিক সকল অধিকার তারা কেড়ে নিয়েছে। দেশের মানুষের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছে তথাকথিত গণতন্ত্রের মানসকন্যা ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার চেতনা বিক্রি করে নির্লজ্জ এক স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছে আওয়ামী লীগ। মানুষ আজ মুক্তির প্রহর গুনছে। যে-ই তাদের মনের কথা বলছে বা সহযোগিতা করতে চাইছে তাদেরকেই দেশের মানুষ আপন করে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো।

তাই আমরা খেয়াল করছি, দেশের রাজনীতি তার ন্যূনতম সৌজন্যতা হারিয়ে আজ দেউলিয়াত্বের পথে। রাজনীতিবিদরা ঘুরছে প্রভাবশালী দেশসমূহের পেছনে পেছনে। গণপ্রজাতন্ত্রের আজ বড়ই নাকাল অবস্থা। ভোটের ব্যবস্থা ধ্বংস করে গণতন্ত্রকে এই ফ্যাসিস্ট সরকার আজ নির্বাসনে পাঠিয়েছে। নতুন উপনিবেশিকতায় আমরা আজ অসহায় হয়ে পড়েছি। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে কয়েকটি দেশের মোড়লিপনা অনেক বেশি। তবে এটা মনে করার কারণ নেই, বিনা কারণে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী হয়ে এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো ‘সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো’। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে রয়েছে আমেরিকা, চীন কিংবা ভারতের অনেক বড় স্বার্থ। আমরা আজ সেই সমীকরণটিই বোঝার চেষ্টা করবো, তাহলেই আপনারা বুঝতে পারবেন আমেরিকার দরবেশীর মূল কারণটা কী।


বৃহত্তর শক্তিসমূহের আধিপত্য বিস্তারই মূল লক্ষ্য

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকা, ভারত কিংবা চীনের হস্তক্ষেপের মূলকারণ দক্ষিণ চীন সাগর ও বঙ্গোপসাগর তথা ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ। তাই সহজ কথায় বলা যায়, এই তিন পরাশক্তির মূল টার্গেট মিয়ানমারের প্রভাব বিস্তার করা। মূলত মাধ্যম হিসেবে বাছাই করেছে বাংলাদেশকে। অনেকটা বাফারস্টেটের মতো করে বাংলাশেকে তারা ব্যবহার করছে। বর্তমানে এই বৃহৎ তিন শক্তির মধ্যে ভারত এবং চীনের নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ থাকলেও আমেরিকার সেভাবে নিয়ন্ত্রণ নেই। একই পরিস্থিতি মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও। আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বকে মোটেও তোয়াক্কা করছেনা মিয়ানমার। অথচ কৌশলগত কারণে আমেরিকার প্রয়োজন মিয়ানমারকে। এর কারণ হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে যে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি ঘোষণা করে, সেখানে তারা দেখিয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলোতে যে জনসংখ্যা সেটা বৈশ্বিক জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি, যার ৫৮ শতাংশই আবার তরুণ। কর্মশক্তি এবং ভোক্তা- দুই হিসেবেই সংখ্যাটা বিশাল। এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক অর্থনীতিরই দুই-তৃতীয়াংশ, জিডিপি’র পরিমাণ হচ্ছে বৈশ্বিক জিডিপি’র ৬০ শতাংশ। এছাড়া বিশ্বে যে সমুদ্র আছে, তার ৬৫ শতাংশ পড়েছে ইন্দো-প্যাসিফিকে, ভূমির ক্ষেত্রে যেটা মোট ভূমির ২৫ শতাংশ। সবমিলিয়ে এই অঞ্চল হয়ে ওঠছে বৈশ্বিক রাজনীতির ভরকেন্দ্র এবং আগ্রহের কারণ। তাই বাংলাদেশের ওপর ভর করে আমেরিকা যেকোনো মূল্যে মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়, আর এতে বাধ সেধেছে ভারত এবং চীন। তাই এ বিষয়টি জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, বাংলাদেশকে নিয়ে এই তিন পরাশক্তির ভূ-রাজনীতিটা কী? এবং কেনইবা মিয়ানমার তাদের কাছে খুব গুরুত¦পূর্ণ? আর এই নিয়ন্ত্রণ নিতে তারা বাংলাদেশকে কিভাবে ব্যবহার করছে বা করবে? 

বিষয়টি অনেক বড় সমীকরণের জালে আবদ্ধ হয়ে আছে। বাংলাদেশকে ঘিরে তিন বৃহৎ শক্তির পরস্পর বিরোধী লড়াইয়ের কারণ অবশ্যই মিয়ানমার। যার কারণে আমেরিকা, চীন ও ভারত একসঙ্গে এখন বাংলাদেশের নির্বাচনী মাঠে। গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত, রোহিঙ্গা ইস্যু, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ আরও নানাবিধ বিতর্কিত ইস্যুতে বিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠলেও ভারত ও চীনের একতরফা সমর্থন পেয়ে এসেছে মিয়ানমার। অথচ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বা হচ্ছে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশ ভারত এবং চীনের কৌশলগত মিত্র হবার পরেও এ ব্যাপারে তাদের কোন সহযোগিতা পায়নি।


বাংলাদেশকে ঘিরে ভারত এবং চীনের দ্বৈত নীতি

মিয়ানমারকে দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার মিলনস্থলের বলা যায়। মিয়ানমার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত ও চীন উভয় দেশের কাছেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের কাছে মিয়ানমারের গুরুত্বের মূল কারণ সেভেন সিস্টার্স (অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা) তথা ভারতের ৭টি অঙ্গরাজ্য। এই সাতটি রাজ্যের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অংশের যোগাযোগ রক্ষা হয় শিলিগুড়ি করিডোর (প্রস্থে ২১ থেকে ৪০ কিলোমিটারের মতো) দিয়ে। এই করিডোরটি পরিচিত ‘চিকেনস নেক’ নামে। এটি খুবই সেনসেটিভ একটি করিডোর। এখানে শক্ত আঘাত আসলে ভারতের সেভেন সিসটার্স পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

এটি জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ‘সেভেন সিস্টার্স’-এর রাজ্যগুলো মূলত খ্রিস্টান মেজরিটি সম্পন্ন। মিশনারীদের দীর্ঘদিনের কার্যক্রমের ফলে মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়ের অধিকাংশ উপজাতি-ই বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত। অন্যদিকে আসামের প্রায় ৫০ শতাংশ জনগণই মুসলিম। ফলে ধর্ম ও বিচ্ছিন্নতাবাদের আতঙ্ক ও ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি দিক দিয়ে এই অঞ্চলটি ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জিং। আসামভিত্তিক স্বাধীনতাকামী সংগঠন উলফাকে নিস্ক্রিয় করতে বহু শক্তি খরচ হয়েছে কেন্দ্র সরকারের। পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের ওপর কেন্দ্র সরকারের আধিপত্য বজায় রাখা এবং সমস্ত স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে দমন করার জন্য এই অঞ্চলে কেন্দ্র সরকারের সহজতর রুটে নির্বিঘœ যোগাযোগ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বর্তমানে দুর্গম ও পাহাড়ি শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে এ অঞ্চলে যোগাযোগ ভারকে বেশ অস্বস্থিতে রেখেছে। অথচ পূর্বাঞ্চলের এই সাতটি রাজ্যের সাথে দিল্লির সহজতম যোগাযোগের রুট হলো বাংলাদেশ বা মিয়ানমার। ভারত অবশ্য এই দুই দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অপেক্ষা মিয়ানমারকে ভারতের অধিক পছন্দ। যদিও কলকাতা থেকে বাংলাদেশের বেনাপোল হয়ে ঢাকা এবং সিলেটের ওপর দিয়ে সহজেই ভারতের আসামসহ অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে যাতায়াত করা যায়। তথাপি ভারতের জন্য আরো সহজ রুট হচ্ছে মিয়ানমার। যার পরে আলোচনায় আসবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভারতে ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা প্রদান করেছে খুবই সহজ শর্তে। যা ভারতের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিলো। ফলে ভারত এখন উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ সমূহে সহজেই পণ্য সরবরাহ করতে পারছে। তাই তাদের পরবর্তী টার্গেট এখন মিয়ানমার।

এখন বড় একটি প্রশ্ন হলো, চীনের কাছে মিয়ানমার কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? চীনের ভৌগলিক অবস্থান খেয়াল করলে এটা সহজেই প্রতিয়মান হয় যে, সে দেশের প্রায় সব বাণিজ্যিক শহর এবং বন্দর দেশটির পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত। আর এ বরাবরই রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগর। এটিই হচ্ছে ভৌগলিক ভাবে চীনা অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অবস্থান। কারণ গত দুই দশক ধরে চীনের ৮৫ ভাগের বেশি বাণিজ্য সমুদ্রপথেই হচ্ছে। আর এই দক্ষিণ চীন সাগর বহিঃবিশ্বের যেকোনো প্রান্তে পৌঁছার জন্য চীনের কাছে একমাত্র মাধ্যম। মানচিত্রে একটু লক্ষ করলেই দেখবেন, দক্ষিণ চীন সাগরের পার্শ্ববর্তী আরো কিছু উদীয়মান অর্থনীতির দেশ রয়েছে। যেমন: মালেশিয়া, তাইওয়ার, ব্রুনাই, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, হংকং ইত্যাদি। দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানা নিয়ে উপরোক্ত দেশগুলোর সঙ্গে চীনের চরম বিরোধ রয়েছে। এ অঞ্চলে চীনের একচেটিয়া আধিপত্যের বিপরীতে এটা বড় একটি বাধা বলে মনে করে তারা। চীন এবং উপরোক্ত দেশগুলোর এই সমুদ্রসীমা বিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন বিরোধী অবস্থান নিয়ে চীনকে বরাবরই চাপে রেখেছে।

 সে কারণে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের অবস্থান এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। যেহেতু চীনের অধিকাংশ বাণিজ্য দক্ষিণ চীন সাগর পেরিয়ে মালাক্কা প্রণালী (মালয়েশিয়ার মালিকানাধীন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক রুট) দিয়ে হয় এবং চীন জানে যে তার সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং তার আঞ্চলিক মিত্ররা চাইলেই চীনের বাণিজ্য বন্ধ করে দিতে পারে। তাই কিছুদিন আগেও তাইওয়ানের সাথে চীনের বেশ খারাপ সম্পর্ক আর উত্তেজনা আমরা লক্ষ করেছি। এক্ষেত্রে আমেরিকা তাইওয়ানকে একচেটিয়া সমর্থন করেছে। আর এটাকেই বলে চীনের মালাক্কা সংকট। তাই চীন দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ চীন সাগরের উপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প বাণিজ্যিক রুট তৈরির চেষ্টা করছে। আর বিকল্প হিসেবে চীনের ভাবনায় রয়েছে দুটি বাণিজ্যিক রুট। 

১. পশ্চিমাঞ্চলীয় রুট: এটি চীনের কাশগড় থেকে পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর হয়ে আরব সাগরে পৌঁছবে। 

২. পূর্বাঞ্চলীয় রুট: এটি চীনের কুনমিং থেকে মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন) হয়ে বঙ্গোপসাগরে  মিলিত হবে।

বিকল্প এই দুটি রুটের মধ্যে দ্বিতীয়টি চীনের বেশি পছন্দ। কেননা চীনের গুরুত্বপূর্ণ সব শহর এবং বন্দর পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত। চীনের এই পূর্বাঞ্চলীয় রুটটি বাস্তবায়ন করতে গেলে মিয়ানমারকে অবশ্যই প্রয়োজন। আর চীনের সাথে যেহেতু বাংলাদেশের কোনো ধরনের সীমানা-সংযোগ নেই, সেহেতু মিয়ানমারের তুলনায় চীনের কাছে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার খানিকটা হলেও কম হবে।


আমেরিকার বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের মূল কারণ কী?

উপরের আলোচনা থেকে এটা সহজেই বলা যায়, বাংলাদেশে আমেরিকার হস্তক্ষেপের মূল কারণ হচ্ছে- চীনকে নিয়ন্ত্রণ করা। যেহেতু চীনের অর্থনীতি আমেরিকার জন্য দিনে দিনে হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চীন আমেরিকার ডলারের উপর ভাগ বসিয়েছে। এছাড়া চীন বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ বিনিয়োগ করছে এশিয়া, আফ্রিকা এবং খোদ ইউরোপের দেশ গুলোতেও। তাই চীনকে ঠেকানোর জন্যই মূলত আমেরিকা এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে। আর চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমেরিকার প্রয়োজন মিয়ানমারের ভূমি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে- আমেরিকা চাইলেইতো মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে তাঁদের অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা করে উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে। কিন্তু না, বিষয়টি হচ্ছে না। আমেরিকা বহুবিদ ব্যবস্থা নিয়েও কোনো সুবিধা সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে করতে পারেনি। চীন ও রাশিয়া থেকে একচেটিয়া সমর্থন পেয়ে সামরিক জান্তা সরকার কোনোভাবেই পশ্চিমাদের কাছে মাথা নত করছে না।

সাম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট সামরিক ব্যয় অনুমোদন আইন পাস করেছে। তবে এ আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, বার্মা আইন বা Burma Unified through Rigorous Military Accountability Act of 2022 এর একটি নতুন সংশোধিত সংস্করণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উক্ত আইনটি অং সাং সুচির দল তথা গণতন্ত্রপন্থীদের সহায়তা করা এবং সামরিক জান্তাকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। উল্লেখ্য ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অগণতান্ত্রিকভাবে সামরিক বাহিনী মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে। এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে অনেক নাগরিক নিহত হয়েছে। জাতিসংঘ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তাতে কোনো কর্ণপাত করেনি সামরিক জান্তা বাহিনী। তবে এ বছরের শেষে তড়িঘড়ি করে একটি নির্বাচন হবার কথা রয়েছে। সামরিক জান্তা সরকার কড়া নির্বাচন-বিধি ঘোষণা করেছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতেই এই ব্যবস্থা। এই পরিস্থিতিতে ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকা মিয়ানমারের বিভিন্ন সংস্থা ও কর্তা ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বিবৃতি জানিয়েছে। আমেরিকার পাশাপাশি কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মিয়ানমারের ওপর। বলা চলে পশ্চিমাদের থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে মিয়ানমার। কিন্তু কোনো কিছুই মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে থামাতে পারছে না।

ফলে আমেরিকা মরিয়া হয়ে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। কারণ, মিয়ানমারের সামরিক শাসকেরা যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে আবার সরকার গঠন করলে আমেরিকার জন্য এ অঞ্চলে প্রবেশ অনেক সময় সাপেক্ষ হয়ে যেতে পারে। ফলে চীন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার প্রভাব বলয় আরো দৃঢ় করে ফেলতে পারে। তারা ভালোভাবেই বুঝতে পারছে চীনকে এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই বাংলাদেশকে ব্যবহার করে আমেরিকা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে চায়। এ জন্যেই আমাদের দেশের প্রতি আমেরিকার এত আগ্রহ। এখন আবার প্রশ্ন আসতে পারে- তাহলে হাসিনা নয় কেন? এই সরকারকে দিয়ে কি আমেরিকা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে না? উত্তরা হলো, না পারবে না। কারণ ভারত চায় না আমেরিকা মিয়ানমারকে নিয়ন্ত্রণ করুক, ফলে তারা বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রধানেরও পরিবর্তন চায় না। বর্তমান সরকার যেহেতু ভারতের বাহিরে গিয়ে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলবে না বা তুলতে পারবে না, তাই এ সরকারের প্রতিই তারা নির্ভরশীল। আর আমেরিকাও বুঝে ফেলেছে বিষয়টি, তাই তারা চায় বর্তমান সরকার বিদায় হোক। গণতন্ত্র বা সুষ্ঠু নির্বাচন আসল কথা নয়, বর্তমান সরকার বিদায়ের পর, হয় নতুন নির্বাচন নতুবা যেকোনা ফরম্যাটে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সুতরাং সমীকরণ এটাই বলছে- ভারতের ভৌগলিক স্বার্থের কারণেই শেখ হাসিনাকে দিয়ে আমেরিকার উদ্দেশ্য হাসিল সম্ভব নয়। তাই তারা চায় এই সরকার বিদায় নিয়ে আমেরিকার সমর্থনপুষ্ঠ একটি সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসুক। যার কারণে তারা এখন হাসিনা বিরোধী শিবিরে আস্থার সৌধ বাড়িয়ে যাচ্ছে। এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পড়েছে বেকায়দায়। কারণ বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনে সরকার জনগণ থেকে মারাত্মকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনাভোটে এমপি হয়েও নেহায়েত গায়ের জোরে ক্ষমতা চালিয়ে যাচ্ছে এ সরকার। আবার ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে করে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছে। জনগণের ম্যানডেট ছাড়া নির্বাচনে জেতা আর আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেলেই যেন সোনার হরিণ হাতে পেয়েছে- এমন মানসিকতার কারণে তাদের এমপি, মন্ত্রী এমনকি চ্যালা-চামুন্ডাদের চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জনগণ আজ অতিষ্ঠ। আর এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমেরিকা গেম প্ল্যান সাজিয়েছে। 

পূর্বেই আলোচনা করেছি, ভারতের কাছে বাংলাদেশ অপেক্ষা মিয়ানমার অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর (মেঘালয়, মিজোরাম, মনিপুর, অরুণাচল, আসাম) সঙ্গে বাংলাদেশের মাধ্যমে সহজে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। কলকাতা থেকে বাংলাদেশের বেনাপোল হয়ে ঢাকা এবং সিলেটের ওপর দিয়ে সহজেই ভারতের আসামসহ অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে যাতায়াত করা যায়। কিন্তু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক কিছু অবস্থানে এসে ভারতীয় স্বার্থের প্রতিকূলে চলে গেছে। যেমন: পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতকে করিডোর দিলে বাংলাদেশ তখন ভারতের থেকে চাইবে ভুটান এবং নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনের জন্য করিডোর। আর ভারত যদি বাংলাদেশকে এই করিডোর দেয় বাংলাদেশ সহজে স্বল্প দূরত্বের ভুটান এবং নেপালের সঙ্গে সড়ক এবং রেলপথে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে। আর উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ তখন নেপাল এবং ভুটানে থাকা ভারতীয় বাণিজ্যে ভাগ বসাতে পারবে।

ভারত এত সহজে নিজ বাণিজ্যে অন্য কাউকে ভাগ দিবেনা। ভারত সরকার এনআরসি এবং সিএএ-এর মাধ্যমে মুসলিম অধ্যুষিত আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গের বেশকিছু জনগোষ্ঠীকে দেশ থেকে বের করে দিতে চায়। তারা নাকি বাংলাদেশের নাগরিক। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের মতো করতে চায়। এ নিয়ে ভারতজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভও সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু বিজেপি তার সে পরিকল্পনা থেকে এখনো সরে আসেনি। ফলে ভারতের এমন পরিকল্পনায় স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ ঢাকা। আর তাই ২০১৯ সালের শেষদিকে ভারতে মন্ত্রী পর্যায়ের বেশকিছু সফর বাতিল করা হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। তাই ভারত মনে করে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যদি তারা একটি যোগাযোগের রুট তৈরি করে, তবে যেকোনো উত্তেজনাকর মুহূর্তে বাংলাদেশে এর সুযোগ গ্রহণ করলেও করতে পারে, এজন্যে ভারতের পছন্দের রুট মিয়ানমার পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য দিল্লির কাছে বাংলাদেশ ব্যতীত আরেকটি সহজ মাধ্যম হলো মিয়ানমার। কলকাতা থেকে সমুদ্রপথে মিয়ানমারের সিওটা বন্দর হয়ে সহজে ভারতীয় ভূখন্ড মিজোরামে প্রবেশ করা যায়। এতে দিল্লির খরচটাও অনেক কম।

আর মিয়ানমারের অর্থনীতি যেহেতু এত উদীয়মান নয়, তাই তারা ভারতের কাছে নেপাল-ভুটানে যাওয়ার জন্য কোনো রুট চাইবে না। এছাড়াও ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে যে রুট তৈরি করছে তা পরবর্তীতে বৃদ্ধি পেয়ে থাইল্যান্ড হয়ে দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত পৌঁছাবে। ফলে ভারতের সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্যের প্রসার হবে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন আর তাইওয়ানের মতো দেশগুলোর সাথে। যা ভারতের অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ ও চীন সাগরের অঞ্চলে আরো কর্তৃত্বশীল করে তুলবে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর রুট তৈরি করলে ভারত থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত পৌঁছাবার সুযোগ পাবে না। ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড কেন্দ্রিক এই প্রস্তাবিত নতুন বাণিজ্যিক রুটের নাম হলো ‘দি এমআইটি হাইওয়ে’। এই হাইওয়েটি বাস্তবায়ন করা গেলে ভারতের একসঙ্গে দুইটি লক্ষ্য অর্জিত হবে। ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সহজে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে, ভারত থাইল্যান্ডের মাধ্যমে দক্ষিণ চীন সাগরেও সহজে পৌঁছাতে পারবে। ভারতের এমন মহাপরিকল্পনায় নেই বাংলাদেশ, এজন্যেই বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের কাছে মিয়ানমারের গুরুত্ব অনেক বেশি। 

ওপরের আলোচনা থেকে সহজেই বুঝা যাচ্ছে- ভারতের সার্বভৌম রক্ষার পাশাপাশি পূর্ব এশিয়ায় নিজের রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে ভারতের কাছে মিয়ানমারের গুরুত্ব অনেক বেশি। আমেরিকা যদি কোনোভাবে মিয়ানমারকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে তবে ভারত এবং চীন উভয়কেই চাপে রাখতে পারবে। আর মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণের জন্যে বাংলাদেশকেই দরকার আমেরিকার, তারা মিয়ানমারকে শায়েস্তা করতে বহুভাবে চেষ্টা করছে, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। এখন আশঙ্কা করা যায়, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে মিয়ানমারের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র পদক্ষেপ নিতে পারে আমেরিকা। আমেরিকা ইতোমধ্যে ভারত সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে ভারত ভেঙে যাবার। কিন্তু চীনকে সামাল দিতে আমেরিকার ভারতেরও প্রয়োজন। তাই ভারতও কৌশল অবলম্বন করছে। কোনো কারণে আমেরিকার বিরাগভাজন হতে চাচ্ছে না, আবার আমেরিকার স্বার্থ দেখতে গিয়ে নিজেদের সার্বভৌমত্বও হুমকির সম্মুখীন করতে চাচ্ছে না। সর্বশেষ মোটা দাগে যে কথাটি বলতে চাই, মিয়ানমার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে চীন এবং ভারতের স্বার্থ অভিন্ন, তাই চীন এবং ভারত দুটি পরস্পর বৈরি শক্তি বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে বৈধতা এবং সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু মিয়ানমারের প্রেক্ষিতে আমেরিকা এবং চীনের স্বার্থ এক নয়। তাই ভারত বাংলাদেশে আমেরিকান নীতিকে পুরোপুরি সমর্থন জানাতে পারছে না। আমেরিকা যদি মিয়ানমারকে টার্গেট না করে শুধু বাংলাদেশকেই নিয়ে চিন্তা করতো, তবে বর্তমান সরকারকে আরো আগেই আমেরিকার চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে হতো।  

John F. Kennedy-এর একটা বিখ্যাত উক্তি রয়েছে- “Domestic policy can only defeat us; foreign policy can kill us..” এমন রাজনীতিতে পিষ্ঠ হয়ে ধ্বংস হয়েছে অনেক দেশের সার্বভৌমত্ব। তাই একটা দেশের নেতাদের অনেক দূরদর্শী হতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও ইসলামের জন্য শেখ হাসিনা এক বিরাট হুমকি। তার শাসনকে কাজে লাগিয়ে ভারত তাদের সকল স্বার্থ উদ্ধার করেছে। শুধু তাই নয় এদেশের আলেম সমাজের ওপরও তারা চালিয়েছে অপরিসীম নির্যাতন। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, সাংস্কৃতিকব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা এমনকি সামাজিকব্যবস্থার মধ্যেও এক বিরাট বিভাজন তৈরি করেছে ‘র’-এর প্রেসক্রিপসনে পরিচালিত আওয়ামী সরকার। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার যদি উদার হয়ে দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তবে এদেশে একটি সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। যা সামাল দিতে আমাদের অনেক ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। আর আমেরিকার হস্তক্ষেপে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে তারা আমাদের কাছ থেকে এর বিনিময় মূল্য অবশ্যই নিয়ে ছাড়বে। আল্লাহ আমাদের এ ভূ-খণ্ডকে হেফাজত করুন। 

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, প্রেরণা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির