post

ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন কর্মকৌশল প্রসঙ্গ

আব্দুদ্দাইয়ান মুহাম্মদ ইউনুছ

২৯ ডিসেম্বর ২০২২

ইসলাম এক পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা এই কথা আজ বিশ্বের আনাচে কানাচে উচ্চারিত হচ্ছে ইসলামী রেনেসোঁ আন্দোলনের বদৌলতে। ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণ, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় অসংখ্য ইসলামী সাহিত্য রচনা ও অনুবাদ, ইসলামী রাজনীতি, ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামী ব্যাংকিং, ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ ইসলামী আন্দোলনেরই বিশেষ অবদান। অতীতে অনেক মুজাদ্দিদ ও মুজতাহিদ ইসলাহ তাজদিদে দ্বীনের কাজ করেছেন। খিলাফত আলা মিনহাজ আন-নবুওয়াতের আলোকে তাজদিদ দ্বীনের জন্য হজরত ওমর ইবন আবদুল আজিজ, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, ইমাম গাজ্জালী, ইমাম ইবন তাইমিয়া, ইমাম নাসায়ী, ইবন জারীর তাবারী, আবু বকর বাকলানী, মুজাদ্দেদ আলফে সানী, সাইয়েদ আহমদ সিরহিন্দ, আল্লামা জামাল উদ্দিন আফগানী, আবদুল ওয়াহাব নাজদী, শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবী, আলজেরিয়ার মালেক বিন-নাবী (১৯০৫-১৯৭৫) প্রমুখ প্রয়াস চালিয়েছেন। ইরানের মির্জা আলী আহমদের বাবী আন্দোলন, লিবিয়ার মুহাম্মদ বিন আলী আস-সেনৈসী আল ইদরিসির সেনৈসী আন্দোলন, তুরস্কের বদিউজ্জমান সাঈদ নুরসীর নুর জামাত, ভারতে সাইয়েদ আহমদ বেরলবী ও শাহ ইসমাঈল শহীদের তরিকায়ে মুহাম্মদী আন্দোলন, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরায়েজি আন্দোলন, মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলনসহ বিভিন্ন নামে অতীতে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন পরিচালিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯২৮ সালে শহীদ হাসানুল বান্না কর্তৃক মিসরে ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী কর্তৃক ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট ভারতবর্ষে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয়। জামায়াতে ইসলামীর একাশি বছর আর ইখওয়ানের ৯৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্তমানে তারই ধারাবাহিকতায় ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের কাজ চলছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি ধারায় ইসলামী দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ পরিচালিত হচ্ছে।

ইসলাহ, দাওয়াত ও তাজদিদে দ্বীনের জন্য যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের সাথে মাওলানা মওদূদী ও ইমাম হাসানুল বান্নার পার্থক্য হচ্ছে অতীতে মুজাদ্দিদ ও মুজতাহিদগণ দাওয়াত ও তাজদিদে দ্বীনের জন্য কোনো সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেননি। মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ প্রভৃতির মাধ্যমে তাঁরা খিদমাতে দ্বীনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করেন। ইসলাহ ও তাজদিদের জন্য সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় কার্যক্রম চালাননি। কিন্তু ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামীর চিন্তাধারায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইক্কামাতে দ্বীনের জন্য বিভিন্ন নামে সুশৃঙ্খল সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। সংগঠনের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের চেইন অব কমান্ড রয়েছে। নিবেদিত লাখ লাখ জনশক্তি আছে যারা দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য জান ও মাল কুরবান করতে প্রস্তুত। “ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন”-কুরআনের এই আয়াতের আলোকে শপথে প্রত্যয়দীপ্ত হয়ে দ্বীনকে জীবনোদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে দাওয়াত ও তাবলিগের জন্য তাঁরা কাজ করছেন। রিসার্চ ও পাবলিকেশন্স, স্কুল, কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা, হাসপাতাল, সুদমুক্ত ইসলামী ব্যাংকিং, সোশ্যাল কেয়ার ও সমাজকল্যাণমূলক অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তাঁদের প্রচেষ্টায়। ইসলামী আন্দোলনের সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের গায়ের রং, মুখের ভাষার পার্থক্য হতে পারে কিন্তু সকলে যেন একই সূত্রে গাঁথা। পৃথিবীর যেই প্রান্তেই অবস্থান করুন না কেন তাঁরা একই দেহের অংশ বিশেষ; রুহামাউ বাইনাহুম তথা পরস্পরের সাথে ভ্রাতৃত্ব ভালোবাসার মায়াবী বন্ধনে তাঁরা আবদ্ধ।  

ইসলামী আন্দোলন নিছক কোনো ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন নয় কিংবা শুধুমাত্র খিদমাতে দ্বীনের কাজ নয়। অথবা খণ্ডিতভাবে দ্বীনের কোনো একটি অংশের ইসলাহ বা সংস্কার আন্দোলন নয়। বরং ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসাবে ব্যক্তি ও সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের আলোকে ঢেলে সাজানোর জন্য এটা ইকামাতে দ্বীনের আন্দোলন। ইসলামী আন্দোলন হচ্ছে দ্বীনি অনুপ্রেরণা যা আল কুরআন থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে সমস্ত উম্মাহকে দ্বীন অনুসরণের জন্য উজ্জীবিত করে। দ্বীন ও দুনিয়ার পার্থক্য করে না। নৈতিক ও বস্তুগত ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ দর্শন দেয়-’’ রাব্বানা আতিনা ফিদ-দুনিয়া হাসানাহ ওয়াফিল আখিরাতে হাসানাহ। কর্মী বাহিনীকে ভারসাম্যপূর্ণ প্রশিক্ষণ প্রদান করে- রুহানিয়াত, আখলাকিয়াত, মুয়ামিলাত, মুয়াশারাত, আদাব, মুখাসামাত, আহকাম, আমসাল, হদুদসহ ইসলামের সকল বিধানের প্রতিই গুরুত্ব দেয়। বিদয়াত নয় ইত্তেবায়ে সুন্নাহর প্রতি দিকনির্দেশনা প্রদান করে। ব্যক্তিগত জীবনে সবরের তালিম দেয় উগ্রতার প্রশিক্ষণ নেই। ক্ষমার দীক্ষা আছে প্রতিশোধপরায়ণতার শিক্ষা নেই। নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাওয়াতি কাজে উদ্বুদ্ধ করা হয় টেরোরিজম বা এক্সট্রিমিজিমের স্থান নেই। জাগতিক স্বার্থে নয় আল্লাহর সন্তুষ্টি কেন্দ্রিক সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সংগঠনের স্বার্থে ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করতে তারা দ্বিধা করে না। নেতৃত্ব ও কর্মীদের মাঝে বস ও সাব-অর্ডিনেট সম্পর্ক নয় বরং ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার সুমধুর সম্পর্ক বিদ্যমান। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ‘বুনয়ানুম মারসুস’ও ‘রুহামাউ বায়নাহুম’-এর যেই সম্পর্কের বয়ান রয়েছে তার আলোকে উখওয়াহর সম্পর্ক বিদ্যমান। সংগঠনে ইতায়াহ তথা আনুগত্য আছে কিন্তু নেতৃত্বের পূজা নেই। আত্মসমালোচনা ও গঠনমূলক ইহতিসাব আছে কিন্তু গিবত-চোগলখুরি নেই। শুরা তথা পরামর্শভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিকতা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে হঠকারিতা নেই। সর্বস্তরে ভোগ নয় বরং ত্যাগ ও কুরবানির প্রতিযোগিতা রয়েছে। একে অপরের শুধু অধিকার সচেতন নয় বরং নিজের চেয়ে অপরকে অগ্রাধিকার দানের নজির স্থাপন করছে।

ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। সশস্ত্র বিপ্লব বা গেরিলা আক্রমণ কিংবা সন্ত্রাসী কার্যক্রম ইসলামী আন্দোলন সমর্থন করে না। ইসলামপন্থীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে সেই সব দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ইসলামী সমাজ বিপ্লবের জন্য কাজ করছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে যারা গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করে গণতান্ত্রিক পন্থায় ইসলামপন্থীরা কোথাও বিজয়ী হলেও তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে তাদের সহ্য হয় না। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে মিসর ও আলজেরিয়া। আলজেরিয়াতে ১৯৯০ সালে ড. আব্বাস মাদানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট বিজয়ী হবার পর সামরিক বাহিনী কর্তৃক উক্ত নির্বাচন বানচাল করা হয় এবং বিজয়ী দলকে ক্ষমতাসীন হবার পরিবর্তে কারাগারে যেতে হয়। পরবর্র্তীতে আলজেরিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় যদিও মূলধারার ইসলামী আন্দোলন তা সমর্থন করেনি। মিসর, ইন্দোনেশিয়াসহ কোথাও কোথাও আল জামায়াহ ইসলামিয়াহ নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও বিশ্বব্যাপী পরিচালিত ইসলামী আন্দোলন অনিয়মতান্ত্রিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা কোনো ধরনের হঠকারী তৎপরতা কোথাও সমর্থন করেনি। 

১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লবের পর বিভিন্ন দেশে ইসলামী আন্দোলনে নতুন এক ঢেউ লাগে। কোথাও কোথাও ইরানের মডেলে বা ইরান বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলামী বিপ্লবের স্লোগান উত্থিত হয়। লেবাননের হিজবুল্লাহসহ কয়েকটি সংগঠন ইরানের শিয়া দর্শনের ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ বিপ্লবের জন্য কাজ করছে। অপরদিকে কয়েকটি ইসলামী সংগঠন বিশ্বব্যাপী খিলাফত কায়েমের স্লোগান দিচ্ছে যেমন হিজবুত তাহরির। কিন্তু হিজবুত তাহরিরের সাথে মাওলানা মওদূদী ও শহীদ হাসানুল বান্নার ইসলামী আন্দোলনের দর্শনে পার্থক্য রয়েছে। তালেবানরা ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। ২০০১ সালে আমেরিকা জোটের আফগানিস্তান দখলের পর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দীর্ঘ সময় আমেরিকার মতো বৃহৎ শক্তির সাথে যুদ্ধ করে। ২০২১ সালে আমেরিকার বিদায় নেওয়ার পর আবারও একের পর এক বিভিন্ন শহর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর রক্তপাতহীন বিপ্লবের মাধ্যমে কাবুল দখল করে ইসলামী আমিরাত অব আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামী রাষ্ট্র বা খিলাফতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শনের বিস্তার লাভ করার পর বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। এই ক্ষেত্রে শুধু পশ্চিমা বিশ্ব নয় বরং অনেক মুসলিম দেশের শাসকরা গণতন্ত্রের লেবাস পরে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করছে। ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করে ইসলামী আদর্শ প্রচার ও প্রসারের পথ রুদ্ধ করা এবং সমাজজীবন থেকে ইসলামী তাহজিব তমদ্দুন পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করাই তাদের অভিন্ন টার্গেট। বিভিন্ন দেশের স্বৈরাচারী সরকারের গায়ের রং এবং ভাষার মাঝে পার্থক্য থাকলেও তাদের জুলুম-নির্যাতনের ধরন প্রায় অভিন্ন। সংক্ষেপে তা হচ্ছে: গ্রেফতার, রিমান্ড, কারাগারে আটক, গুম, খুন, ফাঁসি, মিথ্যা মামলায় হয়রানি, সহায় সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ, সম্পদহানি, অঙ্গহানি, চাকরিচ্যুত করা, ধর্ষণ, মানাবাধিকার লংঘন এবং ইসলামী তাহজিব ও তমদ্দুন নস্যাৎ করার অপচেষ্টা। কিন্তু জুলুম নির্যাতন সত্ত্বেও কোন দেশেই ইসলামী আন্দোলনের মূলধারার নেতৃত্ব গেরিলা হামলা কিংবা সশস্ত্র আন্দোলন সমর্থন করেনি। অথবা লোভ-লালসার ফাঁদে পড়ে ইসলামী আন্দোলনের পথ থেকে বিচ্যুত হন নাই। তারা হাসি মুখে শাহাদাতের মঞ্চে গিয়েছেন কিন্তু আপস করেননি। তবে কোথাও কোথাও সমঝোতা বা কৌশলী ভূমিকা পালন করছে।

তাহরিকে ইসলামীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে ইসলামী আন্দোলন অনেকবার নিষিদ্ধ হয়েছে। সেই সকল দেশে সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ করার পর ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব বিভিন্ন ধরনের কৌশল গ্রহণ করেছে। কিন্তু সকল দেশে একই কৌশল অবলম্বন করা হয়নি। প্রত্যেক দেশের আর্থ-সামাজিক, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে একেক দেশে একেক ধরনের কৌশল নিতে দেখা যায়। আর সংক্ষেপে তা হচ্ছে: 


সংগঠন নিষিদ্ধ হওয়ার পর নতুন নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা : ইসলামী সংগঠন নিষিদ্ধ করা হলে নতুন নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠার কৌশল নিতে কোথাও কোথাও দেখা যায়। বিশেষভাবে তুরস্কের ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা প্রফেসর ড. নাজিবুদ্দিন আরবাকান এই কৌশল অবলম্বন করতেন। ১৯৭০ সালে ড. নাজিবুদ্দিন আরবাকানের নেতৃত্বাধীন হিজবুন নিজামকে নিষিদ্ধ করার পর তিনি ১৯৭২ সালে সালামাত পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৩ সালে আরবাকান সুলেমান ডেমেরিলের নেতৃতাধীন সমাজতান্ত্রিক পার্টির সাথে কোয়ালিশন সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় তাঁর হাতে ছিল। কিন্তু ১৯৮০ সালে সালামাত পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং আরবাকানকে জেলে নেওয়া হয়। তাকে সাত বছরের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। সে সময় তিনি ১৯৮৩ সালে পর্দার অন্তরালে থেকে রাফা পার্টি গঠন করেন এবং ১৯৮৭ সালে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। আরবাকান ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে রাফা পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে কারাগারে নেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে তিনি ফযিলত পার্টি গঠন করেন এবং ২০০১ সালে উক্ত পার্টি নিষিদ্ধ করা হলে তিনি সায়াদাত পার্টি গঠন করেন। উস্তাদ ড. নাজিমুদ্দিন আরবাকান সেক্যুলার তুরস্কে বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত নাম ও কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি তানসুসিলারের মত সেক্যুলারদের সাথে কোয়ালিশন সরকারেও অংশগ্রহণ করেন। 


প্রকাশ্যে তৎপরতা নিষিদ্ধ হলে গোপনে দাওয়াতি কাজ করা : মিসরে বিভিন্ন সময় ইখওয়ান যখন নিষিদ্ধ ছিল তখন ইখওয়ান কর্মীরা গোপনে ব্যক্তিগতভাবে দাওয়াতি কাজ করত। দাওয়াত, সংগঠন মজবুতীকরণ, সমাজ কল্যাণ, প্রফেশনাল বিভিন্ন সংগঠনের নামে পরোক্ষভাবে কাজ করা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রিসার্চ ও থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠা,  মিডিয়া এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। পারিবারিক উসরাহ, প্রফেশনাল উসরাহ, অঞ্চল ভিত্তিক উসরাহ, প্রতিবেশীদের নিয়ে উসরাহ, বয়সভিত্তিক উসরাহ করে ইসলামের কমন বিষয়ে তারা স্টাডি সার্কেল করতো। ১৯৫০ সালে ইখওয়ান নিষিদ্ধ থাকার সময় হিজবুল ওয়াফদ ক্ষমতাসীন হয়। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় ইখওয়ান নাম পরিবর্তন করে নতুন নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করলে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা থাকবে না। সরকারের এই প্রস্তাবে ইখওয়ানের কোনো কোনো নেতা সম্মত হলেও অধিকাংশ একমত হতে পারেননি। পরবর্তীতে রাজা ফারুকের পতনের পর জামাল নাসেরের সময় ইখওয়ানের নেতা-কর্মীদের উপর চরম জুলুম নির্যাতন চালানো হয়। সে সময় তানজিম আস-সিররি তথা গোপন সংগঠন ও তৎপরতার বিরুদ্ধে ইখওয়ান কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিজেদেরকে নিবেদিত করে। যার ফলে নিষিদ্ধ থাকার সময়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে ইখওয়ানের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্রভাবে বা জাতীয়তাবাদী হিজবুল ওয়াফদ বা হিজবুল উম্মালের ব্যানারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে অনেকই বিজয়ী হন। 


রাজনৈতিক কর্মসূচির চেয়ে সামাজিক আন্দোলনে গুরুত্ব প্রদান (Civic Movement) : পৃথিবীর কোথাও কোথাও রাজনৈতিক আন্দোলনের চেয়ে সামাজিক আন্দোলনের প্রভাব বেশি দেখা যায়। যেমন ইন্দোনেশিয়াতে মোহাম্মদিয়া, দেওয়ান দাওয়াহ, নাহদাতুল উলামা প্রভৃতি সংগঠন রাজনৈতিক সংগঠন করার আগে ১৯৪৫ সালে স্বাধীনতা লাভের পর সামাজিক ও দাওয়াহ কার্যক্রম পরিচালনা করে ব্যাপক গণভিত্তি রচনা করে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারাই আসীন হউক না কেন তাদের প্রভাব থাকে। এ থেকে পরিষ্কার যে, রাজনৈতিকভাবে মাঠে নেমে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে যারাই ক্ষমতায় যাক তাদের উপর প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ রেখে অনেক টার্গেট হাসিল করা যায়। তুরস্কের গুলেন মুভমেন্ট এবং ইনন্দোনেশিয়াতে মোহাম্মদিয়াকে State within the state  বলা হয়। যদিও গুলেন মুভমেন্ট ২০০১ সালে একেপির পক্ষে ভূমিকা পালন করলেও পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নেতৃত্বাধীন সরকার উৎখাতে তারা জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

ইন্দোনেশিয়াতে সুকর্নো ও সুহার্তোর সময়ে (১৯৪৫-১৯৯৮) ইসলাম পন্থীরা প্রকাশ্যে কাজ করতে পারেনি। ইসলামপন্থীরা নিজস্ব কোনো প্লাটফর্ম করার পরিবর্তে সকল দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়ে মাসুমী এর ব্যনারে রাজনৈতিক তৎপরতা চালায়। ১৯৬০ সালে উক্ত সংগঠন নিষিদ্ধ হলে ইউনাইটেড ডেভেলপমেন্ট পার্টির ব্যানারে রাজনৈতিক ভূমিকা রাখে। মোহাম্মদিয়া, দেওয়ান দাওয়াহ প্রভৃতি সমাজ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সারা ইন্দোনেশিয়াতে ইসলামের ভিত সৃষ্টি হয়। ১৯৯৮ সালে সুকর্নোর পতন হলে ইখওয়ানের ভাবধারায় প্রভাবিত ইসলামপন্থীরা প্রসপরাস পার্টি ও জাস্টিস পার্টি দু’টি রাজনৈতিক দল করে। কিন্তু ২০০৪ সাল থেকে উক্ত দুইটি দল একীভূত হয়ে জাস্টিস অ্যান্ড প্রসপরাস পার্টি নামে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। 

রাজনৈতিক সংঘাত পরিহার করে মানুষের হৃদয়ে ইসলামের বীজ বপন করা : তুরস্কে বদিউজ্জমান সাঈদ নূরসীর প্রথম জীবনে রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল কিন্তু পরবর্তীতে তিনি সংঘাতের রাজনীতি পরিহার করে মানুষের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের প্রয়াস চালান। তিনি জেলখানা থেকে রিসালায়ে নূর-এর মাধ্যমে তুরস্কে ইসলামী জাগরণ সৃষ্টি করেন। বিশেষভাবে যুবকদের মধ্যে প্রচলিত ও ইসলামের বিরুদ্ধে সকল প্রপাগান্ডার দাঁতভাঙা জবাব পেশ করেন। নাস্তিক্যবাদ ও কমিউনিজমের বিরুদ্ধে তিনি তুলে ধরেন অকাট্য যুক্তিমালা। তাঁরই অনুসরণে ফাতহুল্লাহ গুলেন শিক্ষা ও সমাজ কল্যাণে ব্যাপক ভিত্তিক কর্মসূচি নিয়ে এক সামাজিক আন্দোলন (Social Movement) শুরু করেন; যদিও বর্তমানে গুলেন এর ভূমিকা বিতর্কিত। 


সংগঠনের কাঠামো বিলুপ্ত ঘোষণা : তিউনিসিয়াতে  স্বৈরাচারী বেনআলীর সময়ে হারকাত আন-নাহদাহ এর উপর চরম জুলুম ও নির্যাতন চলে। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে থাকতে হয় বছরের পর বছর। সংগঠনের প্রধান ড. রাশীদ ঘানুশিসহ অনেক নেতা-কর্মী বিদেশে নির্বাসিত জীবন যাপন করেন। এমতাবস্থায় ১৯৯২ সালে সংগঠন বিলুপ্ত ঘোষণা করে সকলেই মদিনার আনসার-মুহাজিরদের মত ‘দুইজন মিলে উখওয়াহ’ কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করেন। সেই সময় সংগঠনের কোনো কাঠামো ছিল না কিন্তু দাওয়াত ইলাল্লাহর ও লোক তৈরির কাজ বন্ধ ছিল না। যার ফলে পরবর্তীতে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হওয়ার পর ২০১০ সালে স্ব-নামে আবার আত্মপ্রকাশ করে এবং নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু ২০২১ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট কাঈস সাঈদ কর্তৃক ক্যু করার পর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিউনিসিয়ার আন-নাহদা পার্টির প্রধান ও পার্লামেন্টের নির্বাচিত স্পিকার ড. রাশীদ ঘানুশিকে ১৪ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা এবং ইনভেস্টিগেশনের নামে গ্রেফতারের পাঁয়তারা ইসলামী রেনেসাঁর আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদেরকে নতুন করে কর্মকৌশল নিয়ে ভাবনায় ফেলছে। 


পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলনের কর্মনীতি ও কৌশলে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেমন: 

১. হিজব ও হারাকা পৃথকীকরণ : ইখওয়ানুল মুসলিমুন ও জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার পর প্রথম পর্যায়ে দাওয়াহ সংগঠন হিসাবে সামাজিক আন্দোলনের মতোই ভূমিকা রাখে। নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে উভয় সংগঠনই নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে। যদিও এই পলিসি নিয়ে উভয় সংগঠনের অভ্যন্তরে বিপরীত চিন্তাও ছিল। কিন্তু অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ শুরু করে। কিন্তু বর্তমানে কোনো কোনো দেশে এই কৌশলের কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন মরক্কোতে বর্তমানে হিজব ও হারাকাহ পৃথকভাবে কাজ করছে। তবে হারাকাহ কর্তৃক হিজব  নিয়ন্ত্রিত নয়। হিজব হচ্ছে রাজনৈতিক শাখা আর হারাকাহ হচ্ছে মূল ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন। মিসরে ২০১২ সালে ইখওয়ানুল মুসলিমুন শুধুমাত্র দাওয়াতি সংগঠন হিসেবে ভূমিকা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। আর ইখওয়ানের সিদ্ধান্তক্রমেই ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে মরক্কো এবং মিসরের ইখওয়ানের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে মরক্কোতে রাজনৈতিক শাখা অনেকটা স্বায়ত্তশাসিত আর মিসরে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি ছিল ইখওয়ান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। ২০১৬ সালে তিউনিসিয়ার আন-নাহদা রাজনীতি ও দাওয়াতি কাজ পৃথক করে। আন-নাহদা রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কার্যক্রম অব্যাহত রাখে কিন্তু দাওয়াতি কাজ এর জন্য নতুনভাবে সংগঠন তৈরি করা হয়নি বরং যারা দাওয়াহ ফিল্ডে ভূমিকা রাখবেন তাঁরা দল থেকে পদত্যাগ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা অঞ্চলভিত্তিক সংগঠনের ব্যানারে কাজ করছেন। ভারতে জামায়াতে ইসলামী দাওয়াতি সংগঠন এবং ওয়েলফেয়ার পার্টি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আছে। সুদানে তিনটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের কাজ চলছে। ক. ন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট- রাজনৈতিক শাখা খ. দাওয়াতে ইসলামী- মূলত কর্মীদের দাওয়াত ও প্রশিক্ষণের কাজ করে। গ. রিলিফ ফান্ড- সমাজকল্যাণ মূলক সংস্থা। এই ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অভ্যন্তরে দাওয়াহ সংগঠন ও রাজনৈতিক শাখা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা চললেও এখনও পূর্বের মতোই রয়েছে।

২. নির্বাচনী রাজনীতি সাময়িকভাবে বর্জন : পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী ১৯৯৭ ও ২০০৮ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে সংগঠনের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে ১৯৯৭ এবং ২০০৮ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। তারা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে ২০১৮ সালে ১টি, ২০১৩ সালে ৪টি, ২০০২ সালে এমএমএ জোটের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ২২টি, ১৯৯৩ তে ৪, ১৯৯০ জোট হিসেবে ১৩ এবং ১৯৮৮ এ জোট হিসেবে ৮টি আসন পায়। পাকিস্তানে জোট হিসেবে অংশগ্রহণ করে কিছুটা ভালো করলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বা বর্জন কোনো ক্ষেত্রেই কাক্সিক্ষত সফলতা পায়নি। ২০১৮ সালে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের উপর চাপ ছিল ইমরান খানের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করতে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান তাতে সম্মত হয়নি। অবশ্য নির্বাচনে তারা আগের তুলনায় রেজাল্ট খারাপ করে। নির্বাচনে ইমরান খান এর তেহরিকে ইনসাফ পার্টি বিজয়ী হয়। নির্বাচন বর্জনের এই কৌশল স্থায়ী নয় বরং এটা ছিল সাময়িক। উল্লেখ্য যে, ২০২২ সালে পাকিস্তানে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদচ্যুত হওয়ার পর তিনি জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের আমীর জনাব সিরাজুল হক-কে ফোন করেন। জামায়াত পাকিস্তানে কোনো পক্ষে অবস্থান নেয় নাই। ইমরান খানকে পদচ্যুত করার জন্য যেমনিভাবে বিরোধী জোটে অংশ নেয়নি অনুরূপভাবে ইমরান খান শেহবাজ শরিফ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামলেও জামায়াত স্বতন্ত্র অবস্থানে রয়েছে। 

৩. নির্বাচনী জোট গঠন এবং কোয়ালিশন সরকারে যোগদান : তুরস্কে নাজিবুদ্দিন আরবাকান সেক্যুলার রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে রাজনৈতিক জোট করে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব নেয়। ১৯৯৬ সালে আরবাকান কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। যদিও পরবর্তীতে সেনাবাহিনী কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হন। সুদানে ড. হাসান তোরাবী প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওমর বাশিরের সাথে ক্ষমতার অংশীদার ছিলেন। মালয়েশিয়াতে ইসলামী পার্টি (পাস) প্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দিন ইয়াসীনের সাথে কোয়ালিশন সরকারে রয়েছে। তিউনিয়িসাতে ড. রাশীদ ঘানুশির নেতৃত্বাধীন আন-নাহদা কয়েকবারই ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠনগুলোর সাথে কোয়ালিশন সরকারে ছিল। যদিও ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট কাঈস সাঈদ সরকার ও পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করেন। বাংলাদেশেও জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সাথে কোয়ালিশন সরকারে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানেও জামায়াতে ইসলামী সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের মন্ত্রিসভায় যোগদান করে। যদিও পরবর্তীতে পদত্যাগ করে। ইন্দোনেশিয়াতেও ইসলামপন্থীরা কয়েক বছর কোয়ালিশন সরকারে ছিল। এইভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অনেক দেশেই নির্বাচন জোট গঠন ও কোয়ালিশন সরকারে যোগদানের নজির রয়েছে। কিন্তু কোয়ালিশন সরকারে অংশগ্রহণের ফলে ইসলামী আন্দোলন কতটুকু লাভবান হয়েছে তার পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা ও গবেষণা চলছে। 

২০১০ সালে আরব বসন্তের পর ইসলামপন্থীদের জনপ্রিয়তা লক্ষ করা যায়। যার ফলে ২০১১ সালে তিউনিসিয়ার নির্বাচনে আন-নাহদা বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। মরক্কোতে ইসলামপন্থীরা এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় রয়েছে। মিসরে ইখওয়ান এর রাজনৈতিক উইং ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং ড. মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ৩ জুলাই সেনাবাহিনী কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হন। অভিযোগ রয়েছে যে মূলত সৌদি আরব ও আরব আমিরাত আরব বসন্তের পর ভীত হয়ে পড়ে। তাদের শঙ্কার কারণ ছিল আরব বসন্তের ঢেউ তাদের দেশে লাগলে রাজতান্ত্রিকতার বিদায় হতে পারে। আর তা হলে ইখওয়ান সেসকল দেশেও জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে। ইন্দোনেশিয়াতেও ইসলামপন্থীরা ভালো রেজাল্ট করে এবং কোয়ালিশন সরকারে ছিল কয়েক বছর। কিন্তু ইসলামপন্থীদের এই বিজয় পশ্চিমা বিশ্ব এবং তাদের দোসর কতিপয় মুসলিম দেশ সহ্য করতে পারেনি। ইখওয়ান ও জামায়াত বর্তমানে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। সৌদি আরব এক সময় ইসলামপন্থীদেরকে নানাভাবে সাহায্য করলেও বর্তমানে ইখওয়ানের সাথে বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে আমেরিকা অনেকটা একক নেতৃত্বে রয়েছে। কমিউনিজম ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলা করার জন্য আমেরিকা ক্ষেত্রবিশেষে মুসলিম কোন দেশ বা ইসলামী সংগঠন ও সংস্থার সাথে কৌশলতগত কারণে কিছুটা নমনীয় ভূমিকা পালন করলেও বাস্তবিকভাবে তার ভূমিকা ছিল ইসলামের বিরুদ্ধেই। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার ইসলামবিরোধী ভূমিকা প্রকাশ্যে চলে আসে। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ডার এর নামে মূলত ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করেছে। আর এই ক্ষেত্রে ২০০১ সালে ১১ই সেপ্টেম্বরের পর সারা বিশ্বব্যাপী A war on terror এর নামে প্রকৃতপক্ষে A War on Islam চলছে। Ivring Kristol wall Street journal এ ১৯৯৬ সালে লিখেছিলেন,  with the end of the Cold War, what we really need is an obvious idelogical and threatening enemy, one worthy of our mettle, one that can unite us in opposition মূলত আজকের পশ্চিমা বিশ্বকে নিজেদের স্বার্থেই ওয়ার অন টেরোর এর নামে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। তাই George Kassimeris Zuvi Playing politics with terrorism গ্রন্থে যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, পশ্চিমা বিশ্ব মূলত কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে রাজনৈতিক খেলা খেলছে। তাদের এই রাজনৈতিক খেলার ক্ষেত্রে মুসলিম নামধারী কিছু শাসক, কতিপয় মিডিয়া ও কথিত এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী দাবার ঘুঁটির মতো ব্যবহার হচ্ছে। আর তাদের কারণেই আফগানিস্তান, কাশ্মীর, লেবানন ও ইরাকের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সিরিয়ায় নির্বিচারে গণহত্যা চলছে।

পাশ্চাত্য ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নীতি বজায় রেখে চলছে। তারা নিজেদের জন্য গণতন্ত্র প্রয়োজন মনে করলেও অন্যদের ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণই তাদের নীতি। গণতন্ত্র সেখানে মুখের ফাঁকা বুলি। যেমন আলজেরিয়ায় গণতান্ত্রিক পন্থায় ভোটের মাধ্যমে ইসলামী স্যালভেশন ফ্রন্ট বিজয় লাভ করার পর গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিতদের ক্ষমতায় যেতে বাধা দিয়ে সামরিক জান্তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার নিয়ে যেভাবে তারা সোচ্চার ভারতে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার নিয়ে তারা সেইভাবে সোচ্চার নয়। ইরান ও সুদানের ব্যাপারে তারা সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে অবরোধ করলেও ইসরাইলের সন্ত্রাস এর বিষয়ে তারা নীরব। মূলত সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো আজ ইসলামের বিরুদ্ধে একাট্টা। এমতাবস্থায় বিশ্বব্যপী ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সম-সাময়িক বিশ্ব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

ইসলামপন্থী নেতৃত্বকে এক সময় গোঁড়া বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু মিসর, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো, কুয়েত প্রভৃতি দেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং উদার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে জোট বা কোয়ালিশন সরকারে অংশ নেওয়ায় ইসলামপন্থীদেরকে ঢালাওভাবে গোঁড়া বা রেডিক্যাল বলার সুযোগ নেই। অপর দিকে আমেরিকা যেসব দেশে ইসলামপন্থীরা জনপ্রিয় ; সেই সব দেশে ইসলামপন্থীরা ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে তাদের সাথে সুস্পর্ক যেন বজায় থাকে সেই নীতিও তাদের রয়েছে। এই ক্ষেত্রে তিউনিসিয়া, মিসর, তুরস্ক, আলজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রত্যেক দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এনে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে এবং কর্র্মকৌশল নির্ধারণ করেছে। এই সকল দেশের ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন এই ধরনের কঠিন পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবিলা করেছে তা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। যদিও প্রত্যেক দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির মাঝে যেমনিভাবে পার্থক্য আছে তেমনিভাবে প্রত্যেক দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এক নয়। তাই এই বাস্তবতার আলোকেই কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। ইসলামী রেনেসাঁর সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদেরকে ময়দানের বাস্তবতা সঠিকভাবে পর্যালোচনা করে কুরআন ও সুন্নাহর মূলনীতির আলোকে সমসাময়িক বিশ্বের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন দেশের কর্মনীতি সামনে রেখে পরামর্শভিত্তিক নতুনভাবে কর্মকৌশল নির্ধারণ সময়ের দাবি। এই ক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক যেমনিভাবে প্রথম রোগ নির্ণয় করে অনুরূপভাবে আমাদেরকে পরিস্থিতির সঠিক পর্যালোচনা করতে হবে। একজন ইঞ্জিনিয়ার কোনো বহুতল ভবন নির্মাণের আগে যেমনিভাবে সয়েল টেস্ট করে অনুরূপভাবে আমাদেরকে জনগণ ও জনশক্তির অবস্থা ভালোভাবে বিবেচনায় আনতে হবে। একজন ড্রাইভার যেমনিভাবে নিরাপদে সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্যই শুধু পিছনের দিকে তাকায়; কিন্তু সার্বক্ষণিক পিছনের দিকে তাকিয়ে থাকলে তার পক্ষে গন্তব্যস্থানে যাওয়া সম্ভব নয়। অনুরূপভাবে আমাদেরকে অতীত পর্যালোচনায় ততটুকু সময় ব্যয় করতে হবে ভবিষ্যৎ পথ চলার জন্য যতটুকু প্রয়োজন। সব সময় যদি পিছনের দিকে তাকিয়ে থাকেন তার পক্ষে সামনে যাওয়া সম্ভব নয়। আর এই ক্ষেত্রে পিছনের অনেক গাড়ি তার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। কখনও কখনও স্থলভাগের কোনো কিছু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য অনেক সময় উপর থেকে দেখতে হয় অনুরূপভাবে ময়দানের অবস্থা পর্যালোচনার জন্য একটু দূর থেকে দেখতে হয়। কিন্তু আবার মনে রাখতে হবে কখনও কখনও দূর থেকে দেখা যায় সামনে পানি কিন্তু কাছে গেলে বুঝা যায় তা পানি নয় বরং মরীচিকা । 

ইসলামী আন্দোলন সমূহ নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ইসলাম সম্পর্কে অনেকেরই ভুল ধারণা রয়েছে। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে অনেকেই মুসলমানদের কর্মকাণ্ডকেই ইসলাম মনে করেন। ইসলামের ইতিহাসের নামে অনেক গ্রন্থে বিভিন্ন মুসলিম শাসকের ইতিহাস লেখা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তার সাথে ইসলামী চরিত্রের মিল নেই। ইসলামী আদর্শ বিরোধী বিভিন্ন কাজকর্মকেই ইসলাম মনে করে অনেকেই বিভ্রান্তিতে রয়েছেন। পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম দেশের সমাজব্যবস্থায় ইসলাম নেই। ২০১৪ সালে ২০৮টি দেশের উপর পরিচালিত এক গবেষণায় ফুটে উঠেছে যে, অনেক মুসলিম দেশে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত নেই; ইসলামী মূল্যবোধ অনুসরণের ক্ষেত্রে সৌদি আরবের স্থান ১৩৫তম। উক্ত গবেষণায় উল্লেখ করা হয় যে, মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ অনেক অমুসলিম দেশে ইসলামের মূল্যবোধ বেশি প্রতিফলিত আছে। (Islamicity Index: ‘Non-Muslim Countries Reflect Islamic Values Better than Muslim Countries’)

যেমন ইসলামের অর্থনৈতিক দর্শন ও সামাজিক সুবিচার নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আয়ারল্যান্ড, ডেনমার্ক, লুক্সেমবার্গ, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, নিউজল্যান্ড এবং বেলজিয়াম পৃথিবীর প্রথম দশটি দেশ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক দেশে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত নেই। দুনীতি, জুলুম, মানবাধিকার লংঘন ও মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেই। শাসকরা ইসলামকে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করেন। কিন্তু তারা ইসলামী মূল্যবোধ অনুসরণ বা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন না। যদিও ইসলামের আলোকেই মুসলমানদের জীবন-জিন্দেগি পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনেক মুসলমানদের জীবন, আচার-ব্যবহার এর সাথে ইসলামের দূরতম কোনো সম্পর্ক নাই। এই ক্ষেত্রে আশার দিক হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামী জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। তবে নেতিবাচক দিক হচ্ছে অনেক মুসলিম দেশের শাসকরাই ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য জুলুম নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাতেও দ্বিধা করছেন। 

ইসলামপন্থীদের বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিভিন্ন দেশে মূলধারার ইসলামী আন্দোলনের সাথে লিবারেল চিন্তাধারার মতপার্থক্য ও নতুন আঙ্গিকে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা। যেমন: মালয়েশিয়াতে ইসলামী পার্টি পাশ থেকে বের হয়ে আমানাহ নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তুরস্কে সায়াদাত পার্টি থেকে বের হয়েই এরদোগান এবং আব্দুল্লাহ গুলের নেতৃত্বে একেপি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০১ সাল থেকে দুই দশক বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে। একেপির মূল নেতৃত্ব ইসলামপন্থী হলেও তাদের রাজনৈতিক দর্শন সেক্যুলার কাঠামোর ভিতরই রয়েছে। মালয়েশিয়াতে ড. আনোয়ার ইবরাহীমও আবিমের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু তিনি পরবর্তীতে ডা. মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন আমনুতে যোগ দিয়ে উপপ্রধানমন্ত্রী হন। অবশ্য পরবর্তীতে মাহাথির তাঁকে পদচ্যুত করে কারাগারে প্রেরণ করেন। ২০১৮ সালে মাহাথির-আনোয়ার ইবরাহীম আবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও নির্বাচন করে সরকার গঠন করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ২০২০ সালে মাহাথির মোহাম্মদ এবং আনোয়ার ইবরাহীমের সম্পর্কে ফাটল ধরে। মাহাথির চুক্তি অনুযায়ী আনোয়ার ইবরাহীমকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন নাই। অবশ্য তিনিও আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী হন মহিউদ্দিন ইয়াসীন। এরপর আনোয়ার এবং মাহাথির আবারও ঐক্যবদ্ধভাবে মহিউদ্দিন ইয়াসীনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। আর ইসলামপন্থী পাস সরকারের সাথেই ছিল। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে মাহাথির-আনোয়ারের নেতৃত্বে আন্দোলনের জের ধরে প্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দিন ইয়াসীন পদত্যাগ করার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিল আমনুর ইসমাঈল শিবরী। তিনি পার্লামেন্টে ১১৪ ভোট পান আর তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইবরাহীম পান ৯৯ ভোট। এই ক্ষেত্রে ইসলামপন্থী পাসের সমর্থন যদি আনোয়ার ইবরাহীম পেতেন তাহলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। ২০২২-এ এসে মালয়েশিয়ার গত ১৯ নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় ঝুলন্ত পার্লামেন্টে ছিল। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আনোয়ার ইবরাহীম দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এই নির্বাচনে মালয়েশিয়ার রাজনীতির জায়ান্ট হিসেবে পরিচিত মাহাথির মোহাম্মদের মারাত্মক পতন এখন আলোচনার বিষয়। তিনি মালয়েশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রীই শুধু ছিলেন না, বরং আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার বলা হয় তাকে। বর্তমানে ৯৭ বছর বয়সী ড. মাহাথির আবার পার্লামেন্টের ভোটে দাঁড়ানোর পর নির্বাচনে জয় তো দূরের কথা তার নিজের এবং তার নতুন গঠিত দলের সবার জামানত পর্যন্ত বাতিল হয়েছে। কারণ তার আসনে যত ভোট পড়েছে তার আট ভাগের এক ভাগও আদায় করতে পারেনি তিনি। এছাড়া তার দল কোনো আসনে জয়লাভ করেনি। গত ৫৩ বছরে এটাই মাহাথির মোহাম্মদের প্রথম কোন নির্বাচনে পরাজয়ের ঘটনা।

বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী থেকে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক পদত্যাগ করে তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে আমার বাংলাদেশ নামক রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এইভাবে বিভিন্ন দেশে ইসলামী আন্দোলন থেকে একটি অংশ বের হয়ে লিবারেল ধারার রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার এক নয়া ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। বিশেষভাবে অনেকেই তুর্কি মডেল ব্যবহার করছেন। তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এরদোগান সেক্যুলার সিস্টেমের ভিতরই প্রায় দুই দশক ধরে তুর্কি শাসন করছেন। আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে যেখানে হিজাব পরিধান করার কারণে একজন সংসদ সদস্যাকে পার্লামেন্টে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি সেই তুরস্কে হিজাব পরিহিতা নারী প্রেসিডেন্টের দু-ভাষী হিসাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে মিটিং হিজাব পরিহিতাকেই বাছাই করে বিশ্বকে এক বার্তা দেওয়া হয়েছে। তুর্কি মডেল বলতে তাঁরা সেক্যুলার সিস্টেমের ভিতর আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা পোষণ করেন।

ইসলামী দাওয়াহ সংগঠনগুলোকে পর্যালোচনা করতে হবে যে ইসলামী আন্দোলন সমূহের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে গৃহীত কর্মকৌশল কি যথার্থ? এই ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনা কি জরুরি। পর্যালোচনা করে দেখতে হবে নেহাতই পরিবর্তনের কথা বলে যাঁরা নতুন চিন্তা করছেন তাঁদের চিন্তাধারা কি আসলেই কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের জন্য যথাযথ? ইসলামী দাওয়াহ সাংগঠন সমূহের মাঝে পারস্পরিক সমন্বয় ও চিন্তাধারায় ঐক্য সাধনে কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত তা সকলকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। ইসলামী আন্দোলন সমূহকে একদিকে বাস্তবতা পর্যালোচনা করে আল্লাহর রাসূলের জীবন ও জিন্দেগি থেকে কর্মনীতি ও কর্মকৌশল নিতে হবে। এই ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা. হচ্ছেন উসওয়ায়ে হাসানাহ। 

আল্লাহ তায়ালা অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে ইসলাম কায়েম করে দেন না। তিনি ইসলাম বিরোধীদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে ইসলামকে বিজয়ী করে দিতে সক্ষম। কিন্তু তা তিনি করেন না। তিনি তখন মুসলমানদেরকে সাহায্য করে যখন মুসলমানরা দ্বীন কায়েমের জন্য চেষ্টা করে। খন্দকের যুদ্ধে তিনি ঝড় বৃষ্টি দিয়ে বিধর্মীদের তাঁবু ও রসদপত্র তছনছ করে দিলেন। নমরুদকে সামান্য একটি মশা দিয়ে কিভাবে হেস্তনেস্ত করলেন-তার ইতিহাস সবারই জানা। নমরুদের বিশাল বাহিনী ক্ষুদ্র মশা বাহিনীর আক্রমণে শেষ হয়ে গেল। ফেরাউনকে নদীতে ডুবিয়ে মারলেন আর মুসাকে সেই নদীতেই বিনা বাহনে একপাশ থেকে আরেক পাশে পার করে দিলেন। ইবরাহীমকে আগুনে নিক্ষেপ করার পর আগুনের দাহ্যশক্তি নষ্ট করে দিলেন। আগুনকে নির্দেশ দিলেন ইবরাহীমকে তাপের স্পর্শ দিয়ে কষ্ট না দিয়ে আরামদায়কভাবে রাখার জন্য। আবার প্রিয় হাবিবকে তায়েফে রক্তে রঞ্জিত হতে হলো। সে সময় কাফেরদের হাত অবশ করে দিতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। ওহুদে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় রাসূলকে ডেকে বলতে হলো- তোমাদের মধ্যে কে আছ যে ঢাল হিসেবে আমার সামনে দাঁড়াতে পারবে? আল্লাহ তায়ালা মাঝে মধ্যে নবী-রাসূলদের মুজেযা দেখিয়েছেন কিন্তু তা সাধারণ নিয়ম ছিল না। অস্বাভাবিক পন্থায় তিনি তার দ্বীন দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দ্বীনের বিজয় দান করেছেন।

বর্তমানে আমরা ফতোয়াবাজির মহারোগ দেখছি। আমার দৃষ্টিতে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাজ হচ্ছে নিজেরা সহীহ আকিদার ওপর চলা; অন্যদেরকে ইসলাহ করার চেষ্টা করা। কিন্তু মুফতি কিংবা বিচারকের দায়িত্ব পালন করা তাদের কাজ নয়: কে জান্নাতে যাবে কে যাবে না তা আল্লাহ ফায়সালা করবেন। কিন্তু কী ধরনের আকিদা পোষণকারীরা জান্নাতে যাবে আর কী ধরনের আকিদা পোষণকারীরা জান্নাতে যাবে না তা কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ আছে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে মানুষের ভ্রান্ত আকিদার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে; ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। ব্যক্তিকে দরদ ও ভালোবাসা দিয়ে সংশোধন করার চেষ্টা করতে হবে। এটাই আল্লাহর রাসূলের সুন্নাত; নীতি ও আদর্শ। 

আমরা আজকের সমাজে আরেকটি বিষয় লক্ষ করি যে, মানুষ নিজে অন্যের সমালোচনা করলেও নিজের সমালোচনা অন্য কেউ করুক তা পছন্দ করে না। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তিনিই ভালো মানুষ যিনি অন্যের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকেন এবং অন্য কেউ তাঁর সমালোচনা করলে তা হাসিমুখে বরণ করে ভুল ত্রুটি সংশোধন করেন। কোনো কাজে ব্যর্থতার দায়ভার অন্যের কাঁধে দেওয়ার চেয়ে নিজের কাঁধে নিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না; সফলতা নয় ব্যর্থতার দায় কাঁধে নেওয়ার মধ্যেই কৃতিত্ব বেশি। নিজে কারো কাছ থেকে কিছু পাবার আকাক্সক্ষা নয়; বরং কাউকে কিছু দেওয়ার আকাক্সক্ষা থাকা ভালো। অন্যকে সম্মান করলে নিজে সম্মান পায়; এমনকি একটি ছোট ছেলেকেও সম্মান করলে সে অধিক ভক্তি করে। কোনো কাজ করার সময় আমরা ভাবি মানুষে কী বলবে? কিন্তু এ কথা খুব কমই ভাবি আল্লাহ কী বলবেন? দুনিয়াতে কেউ কারো সাথে খারাপ আচরণ করলে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা অনেকেরই মাঝে দেখা যায়। কিন্তু মানুষ যদি এ কথা মন থেকে উপলব্ধি করতো প্রতিশোধ নেওয়ার চেয়ে ক্ষমা করার মধ্যেই কৃতিত্ব বেশি। আর এতে আল্লাহও খুশি হন। তাহলে দুনিয়াতে এত মারামারি হানাহানি হতো না। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের একটি কথা, একটি লেখা, অল্প একটু দান নাজাতের উসিলা হতে পারে। আবার অঢেল সম্পদ দান, অনেক ওয়াজ নসিহত ও হাজারো পৃষ্ঠার বই নাজাতের পরিবর্তে দোজখের আগুনে জ্বলার কারণও হতে পারে। খুলুসিয়াতের সাথে অল্প আমল করলেও অনেক নেকি মিলে। আবার প্রদর্শনেচ্ছার কারণে অনেক আমল করেও নেকি শূন্য থাকতে হয়। তাই সকল কাজ খুলুসিয়াত এর সাথে হচ্ছে কি না বারবার আত্মপর্যালোচনা করা দরকার। 

লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

Munzir Abrar

- 1 year ago

নাজমুদ্দিন এরবাকান ৭৩ এ সমাজতান্ত্রিক CHP এর সাথে কোয়ালিশন করেন যার নেতৃত্বে সুলেমান ডেমিরেল নয়,বুলেন্ত এজবিদ ছিলেন, সংশোধনের অনুরোধ...

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির